Sunday, November 19, 2017

চালতা/Chalta/Dillenia indica/Elephant Apple

চালতা (বৈজ্ঞানিক নাম: Dillenia indica) এক রকমের ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ। চালতার ফল খুব আদরণীয় নয়। এই ফল দিয়ে চাটনি ও আচার তৈরি হয়। এটি স্থানবিশেষে চালিতা, চাইলতে ইত্যাদি নামেও অভিহিত।[১] এর ইংরেজী নাম Elephant Appleগাছটি দেখতে সুন্দর বলে শোভাবর্ধক তরু হিসাবেও কখনো কখনো উদ্যানে লাগানো হয়ে থাকে।চালতার জন্ম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এটি বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশে জন্মে।
চালতা গাছ মাঝির আকারের চিরহরিৎ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। এ গাছ উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। গাছের গায়ে লালচে রঙের চকচকে বাকল থাকে। পাতার কিনারা খাঁজ কাটা, শিরা উঁচু
সমান্তরাল। চালতার সাদা রঙের ফুল দেখতে সুন্দর ; এটি সুগন্ধযুক্ত। ফুলের ব্যাস ১৫-১৮ সেন্টিমিটার। ফুলে পাঁচটি মোটা পাঁপড়ি বেষ্টিত কেন্দ্রে প্রচুর হলুদ পুংকেশর থাকে ; বৃতিগুলো সেসব পাঁপড়িকে আঁকড়ে ঘিরে রাখে। বছরের মে-জুন মাসে ফুল ফোটার মৌসুম।
ফল টক বলে চালতার আচার, চাটনি, টক ডাল অনেকের প্রিয় খাদ্য। পাকা ফল পিষে নিয়ে নুন-লংকা দিয়ে মাখালে তা বেশ লোভনীয় হয়। গ্রাম এলাকায় সাধারণত জঙ্গলে এ গাছ জন্মে ; কখনো কখনো দু’একটি গাছ বাড়ির উঠানে
দেখা যায়। চালতা ফলের যে অংশ খাওয়া হয় তা আসলে ফুলের বৃতি। প্রকৃত ফল বৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকে। ফল বাঁকানো নলের মত ; ভিতরে চটচটে আঠার মধ্যে বীজ প্রোথিত থাকে। চালতা অপ্রকৃত ফল; মাংসল বৃতিই ভক্ষণযোগ্য।
গুনাগুণ :
-   ঠান্ডা লেগে জ্বর হলে এর রস অনেক উপকারে লাগে।
-   বাতের ব্যথাতে কচি চালতার রস পানির সাথে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
-   রক্ত আমাশয়ের জন্য চলতার কচি পাতার রস উপকার।
-   কফ ও সর্দির জন্য গাছের ছালেত গুঁড়া নিরাময়ের কাজ করে।
চালতার পুষ্টির মূল্য
"ফল ও বাদামের এনসাইক্লোপিডিয়া," অনুযায়ী,  ভোজ্য অনুযায়ী, চালতার মাংসের 100 গ্রাম প্রতি পুষ্টির মূল্য হলো:
59 kcal
.8% প্রোটিন
.2-2.5% ফ্যাট
2.1-2.5% ফাইবার
3.54% অ্যাশ
16 মিগ্রা ক্যালসিয়াম
26 mg ফসফরাস
4 মিলিগ্রাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড
চালতা একটি অবহেলিত ফল হলেও এর রয়েছে নানা খাদ্যগুণ। যেমন -
*চালতা ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন '', 'বি' 'সি'-এর ভালো উত্‍স। *প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'সি' থাকায় এই ফল স্কার্ভি ও লিভারের রোগ প্রতিরোধ করে।
*চালতায় রয়েছে বিশেষ ধরনের কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা জরায়ু ও স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ করে। *চালতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ যা বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। *চালতায় উপস্থিত আয়রন রক্তের লোহিতকণিকার কার্যক্রমে সহায়তা করে। রক্তের সংবহন ঠিক রাখে। চালতার বিভিন্ন উপাদান হার্টের নানা রোগ প্রতিরোধেও সহায়তা করে। *চালতা পেটের নানা অসুখ প্রতিরোধে সহায়তা করে। ডায়রিয়া সারাতে কাঁচা চালতার রসের তুলনা নেই।
*রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে চালতা। *ঠান্ডা ও কাশির জন্য পাকা চালতার রস চিনি মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। *কিডনীর নানা রোগ প্রতিরোধেও সহায়তা করে চালতা। *শুধু ফল নয়, চালতার মূল ও পাতারও রয়েছে ঔষধীগুণ। মচকে গিয়ে ব্যথা পেলে সেখানে চালতা গাছের মূল ও পাতা পিষে প্রলেপ দিলে ব্যথা কমে যায়।
শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, রূপচর্চার উপাদান হিসেবেও রয়েছে চালতার ব্যবহার। যেমন -
*কাঁচা চালতার পানিতে মিশিয়ে চুলের গোড়ায় নিয়মিত লাগালে চুল পড়া কমে যায়। *কাঁচা চালতার রসের সাথে পেঁয়াজের রস মিশিয়ে সপ্তাহে দুবার চুলের গোড়ায় লাগালে খুশকি দূর হয়ে যাবে। *চালতার রসের সাথে চালের গুঁড়া মিশিয়ে স্ক্রাবার হিসেবে ব্যবহার করলে মরাকোষ পরিষ্কারের পাশাপাশি ত্বক হয়ে ওঠে উজ্জ্বল ও কোমল। *চালতার রস টোনার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। চালতার রসের সাথে মধু মিশিয়ে তাতে তুলো ভিজিয়ে ত্বকে লাগান। দশ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। ত্বকে বলিরেখা পড়া বিলম্বিত করে এই টোনার। *চালতার রসের সাথে চিনির গুঁড়া মিশিয়ে ত্বকের কালো অংশগুলোতে লাগান। আঙুল দিয়ে হালকা মাসাজ করুন দশ-পনেরো মিনিট। এরপর ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে ত্বকের কালচে ভাব দূর হয়ে যাবে।
চালতার আচার
উপকরণ
চালতা – ৩ টা

গুড় – ১/২ কেজি
লবন – ১ চা চামচ
বিট লবন – ১/২ চা চামচ
হলুদ গুঁড়া - ১/২ চা চামচ
মরিচ গুঁড়া - ১ চা চামচ
ধনে গুঁড়া - ১/২ চা চামচ
পাচ ফোড়ন – ১ চা চামচ
এলাচ – ৪ টা
দারুচিনি – ২ টুকরা
জিরা – ১ চা চামচ
লাল মরিচ – ৪/৫ টা
সরিষার তেল – ১/২ কাপ
প্রণালী
- চালতা কেটে বেছে ধুয়ে পানিতে সিদ্ধ করে পাটায় ছেচে নিন।
- কড়াইয়ে চালতা,গুড়, লবন, হলুদ, মরিচ ও ধনে গুঁড়া দিয়ে বসিয়ে দিন।
- জ্বালে গুড় গলে মাখা মাখা হলে বাকি সব মসলা হালকা টেলে গুঁড়া করে চালতায় দিন।
- সরিষার তেল দিয়ে আরো কয়েক মিনিট জ্বাল করে নামিয়ে নিন।
চালতার টক মিষ্টি আচার
উপকরণ
চালতা ৪টি। তেল আধা কাপ। পাঁচফোড়ন-গুঁড়া ১ চা-চামচ। শুকনামরিচ-গুঁড়া ৪টি। সরিষাবাটা ২ চা-চামচ। হলুদ ১ চা-চামচ। মৌরি ৩ চা-চামচ। লবণ স্বাদমতো। গুড় ১ কাপ। চিনি ১ কাপ। লাল খাবার রং  অল্প (নাও দিতে পারেন)। সিরকা ১ কাপ।
পদ্ধতি
চালতা ধুয়ে কেটে লম্বা লম্বাফালি করে কাটতে হবে। কাটা চলতা পানি দিয়ে সিদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নিন।
বড় টুকরাগুলো শিল-পাটায় ভালো করে ছেঁচে নিন।
কড়াইতে তেল গরম হলে পাঁচফোড়ন গুঁড়া, মৌরি, লবণ, গুঁড় ও বাকি মসলাগুলো দিয়ে দিন। গুড় গলে গেলে চালতা দিয়ে নাড়তে থাকুন।
চালতার মিষ্টি আচার
উপকরণ :
চালতা দেড়টি, চিনি ২ কাপ, মৌরি ২ টেবিল চমচ, লবণ স্বাদমতো, শুকনা মরিচের
গুঁড়া দেড় চা চামচ, জাফরান রঙ ১ চা চামচ, সরিষা গুঁড়া ১ টেবিল চামচ, সিরকা আধা কাপ।
প্রস্তুত প্রণালি :
১টি চালতা ৬ বা ৮ টুকরা করে নিয়ে ভেতরের ময়লা ফেলে দিতে হবে। চালতা আধা ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। গরম পানিতে চালতা সিদ্ধ করে নিতে হবে। চালতা সিদ্ধ হলে ছেঁকে নিতে হবে। এবার চিনির সিরা করে তাতে জাফরান রঙ, লবণ, মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে চালতা জাল দিতে হবে। পানি শুকিয়ে এলে সিরকা ও সরিষা গুঁড়া দিতে হবে। মৌরি ঢেলে গুঁড়া করে চালতার ওপর ছিটিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
আলুতে চালতার টক
উপকরণ:
চালতা ছোট টুকরা ১ কাপ, সেদ্ধ করে চটকানো মিষ্টি আলু ২ কাপ, পানি ৪ থেকে ৫ কাপ, হলুদের গুঁড়া সামান্য, কাঁচা মরিচ
ফালি ২টি, রসুন কুচি ১ চা-চামচ, পেঁয়াজ কুচি ১ টেবিল চামচ, আদাবাটা ১ চা-চামচ, লবণ স্বাদমতো, তেল ২ টেবিল চামচ, পাঁচফোড়ন ১ চা-চামচ।
প্রণালি:
সসপ্যানে আলু ও পানি দিয়ে নেড়ে নিন। তারপর হলুদের গুঁড়া, রসুন কুচি, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা মরিচ, আদাবাটা ও লবণ দিয়ে জ্বাল দিন। পানি ফুটে গেলে তাতে চালতার টুকরাগুলো দিন। চালতা সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজন হলে আরও ২ কাপ পানি দেওয়া যেতে পারে। সবশেষে তেলে পাঁচফোড়ন দিয়ে চালতার টকে ফোড়ন দিয়ে নামিয়ে নিন।
চালতা-ডাল
উপকরণ
মাঝারি আকারের চালতা ১টি, মসুর ডাল ১ কাপ, পেঁয়াজ কুচি সিকি কাপ, রসুন কুচি
১ টেবিল চামচ, কাঁচা মরিচ ৪টি, লবণ পরিমাণমতো, হলুদ গুঁড়া আধা চা-চামচ, সরিষার তেল ২ টেবিল চামচ ও পাঁচফোড়ন গুঁড়া সিকি চা-চামচ।
প্রণালি

চালতা টুকরা করে সামান্য লবণ ও হলুদ মাখিয়ে ১ টেবিল চামচ তেল গরম করে অল্প নাড়াচাড়া করে পানি দিয়ে আধা সেদ্ধ করে নিন। ডালের সঙ্গে বাকি উপকরণ মেখে কিছুক্ষণ রেখে গরম পানি দিয়ে ডাল রান্না করুন। ডাল সেদ্ধ হয়ে এলে চালতা দিয়ে কিছুক্ষণ চুলায় রেখে নামিয়ে নিন।

No comments:

Post a Comment