কচু
কচু Araceae গোত্রভূক্ত একধরনের কন্দ জাতীয় ফসল। কচু মানুষের দ্বারা চাষকৃত
প্রাচীন উদ্ভিদগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব এলাকায় কম
বেশি কচু দেখতে পাওয়া যায়। রাস্তার পাশে, বাড়ির আনাচে
কানাচে, বিভিন্ন পতিত জমিতে অনাদরে-অবহেলায় অনেক সময়
কচু হয়ে থাকতে দেখা যায়। বহু জাতের কচু রয়েছে। কিছু কিছু জাতের কচু রীতিমত
যত্নের সাথে চাষ করতে হয়। কচুর উৎপত্তি ভারতীয় দ্বিপপুঞ্জ সহ দক্ষিন-পূর্ব
এশিয়াতে। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বেও কচুর চাষ করা হত। কচু মাটিতে ও পানিতে দুই
স্থানেই বেশ সহজেই জন্মাতে পারে। তবে মাটিতে জন্ম নেয়া কচুর সংখ্যাই বেশি। অনেক
প্রজাতির কচু আছে যেগুলো বনে জঙ্গলে জন্মে থাকে,এগুলো
বুনো কচু নামে পরিচিত। এই ধরনের কচু মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়। মানুষের খাওয়ার
উপযোগী জাতের ভেতরে, মুখী কচু ,দুধ
কচু, মান কচু, পানি কচু, পঞ্চমুখী কচু ও ওল কচু উল্লেখযোগ্য। কচুর মূল, লতি, পাতা ও ডাটা প্রায় সব অংশই খাওয়ার উপযোগী
৷
বনে জঙ্গলে যেসব কচু আপনাআপনি জন্মায় সেগুলকে সাধারণত বুনো কচু বলা হয়।
এধরনের কচুর অনেকগুলো জাত মানুষের খাবারের উপযোগী নয়। খাবার উপযোগী জাতগুলোর
অন্যতম হচ্ছে মুখীকচু, পানিকচু, পঞ্চমুখী কচু, পাইদনাইল, ওলকচু, দুধকচু,
মানকচু, শোলাকচু ইত্যাদি। সবজি হিসেবে
ব্যবহার ছাড়াও সৌন্দর্যের কারণে কিছু কিছু প্রজাতির কচু টবে ও বাগানে চাষ করা
হয়। এদের মধ্যে কতগুলোর রয়েছে বেশ বাহারী পাতা, আবার
কতগুলোর রয়েছে অত্যন্ত সুন্দর ফুল।
কচুর মূল উপদান হল আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রেখে শরীরে
অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখে। প্রতি ১০০ গ্রাম কচুশাকে ৩৯ গ্রাম প্রোটিন, ৬.৮ গ্রাম শর্করা,
১৫ গ্রাম চর্বি, ২২৭ মিলি গ্রাম
ক্যালশিয়াম, ১০ মিলি গ্রাম আয়রন, ৫৬ মিলিগ্রাম খাদ্যশক্তি থাকে। কচুতে অক্সিল এসিডের উপস্থিতি থাকায়
খাবার পর মাঝে মাঝে গলা চুলকায়।
কচুর উৎপত্তি-
অনুমান করা হয়, কচুর উৎপত্তি ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। প্রায় দু'হাজার বছর আগেও কচুর চাষ হত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্থলভূমি ও জলভুমি
উভয় স্থানে কচু জন্মাতে পারে। তবে স্থলভাগে জন্মানো কচুর সংখ্যাই বেশি। কচুর বহু
আয়ূর্বেদীয় গুনাগুন আছে বলে দাবি করা হয়।
বিভিন্ন রকম কচু-
বনে জঙ্গলে যেসব কচু আপনাআপনি জন্মায় সেগুলোকে সাধারণত বুনো কচু বলা হয়।
এর সবগুলো মানুষের খাবারের উপযোগী নয়। খাবার উপযোগী জাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে
মুখীকচু, পানিকচু, পঞ্চমুখী কচু, ওলকচু, দুধকচু, মানকচু,
শোলাকচু ইত্যাদি।
মুখী কচু-
মুখী কচু একটি সুস্বাদু সবজি । এ সবজি খরিফ মৌসুমের জন্য খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ হয়। মুখী কচু বাংলাদেশের গুড়া কচু, কুড়ি কচু,
ছড়া কচু, দুলি কচু, বিন্নি কচু, ইত্যাদি নামে ও পরিচিত।মুখী কচুতে
প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ‘এ’ এবং লৌহ থাকে।
ওল কচু-
এতে পুষ্টি ও ঔষধি মূল্য উভয়ই বিদ্যমান এবং সাধারণত রান্না করে তরকারি
হিসেবে খাওয়া হয়। বাংলাদেশে এটি গ্রীষ্ম মৌসুমে জন্মে যখন বাজারে সবজির খুব
ঘাটতি থাকে। ওল কচুর রস,
উচ্চরক্তচাপের রোগীকে প্রতিষেধক হিসেবে খাওয়ানো হয়। পার্বত্য
চট্টগ্রামে ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে এর আবাদ হয়।
মান কচু-
মান কচুর ডগা ও পাতা বাতের রোগীকে খাওয়ানোর প্রথা এ দেশের ঘরে ঘরে প্রচলিত
রয়েছে। কচু শাকে পর্যাপ্ত আঁশ থাকায় এটি দেহের হজমের কাজে সহায়তা করে।
পাইন্যা কচু-
পানিতে হয় বলে সম্ভবতই এর নাম পানি কচু। তবে বেশির ভাগ মানুষের কাছে
পাইন্যা কচু হিসেবে পরিচিত।
পানি কচুই হোক কিংবা পাইন্যা কচুই হোক সব্জি হিসেবে এর
গুরুত্ব ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি একটি
জনপ্রিয সব্জি। কারণ এর স্বাদ এবং পুষ্টিমান ও অত্যাধিক, রান্না করাও সহজ।
কচু দিয়ে রান্না-
প্রজাতিভেদে কচুর মুল, শিকড় বা লতি, পাতা ও ডাটা সবই
মানুষের খাদ্য। কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ অনেকেরই খাদ্য তালিকায় পছন্দের মধ্যে
আছে। এছাড়াও কচুর লতি চচ্চড়ি, কচুর লতির ভুনা, কচুর লতির ইলিশ, কচুর লতির কোরমা, সরিষা বাটায় কচুর লতি আরও কত রকমের খাবার যে রান্না করা যায় তার
ইয়ত্তা নেই।
কচুর উপকারিতা-
- কচু শাকে প্রচুর পরিমাণে “ভিটামিন এ” থাকায় রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এটি
অত্যন্ত উপকারী।
- কচু আঁশ জাতীয় হওয়ায় এটি কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করে।
- কচুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ক্যালসিয়াম যা আমাদের হাড় শক্ত
করতে সহায়তা করে।
- চুলের ভঙ্গুরতাও বন্ধতেও কচুর উপকারিতা অনেক।
- কচুতে আয়োডিনের পরিমাণও অনেক।
- যাদের গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটি রয়েছে তাদের জন্য কচু অনেক উপকারী।
- কচুর লতিতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরাও
নিশ্চিন্তে খেতে পারেন এটি।
কচুর ভর্তা
উপকরণ: কচুর গোড়ার অংশ ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি আকারের।
ছোটচিংড়ি ১ মুঠ। বড় পেঁয়াজ ১টি, মোটা করে কাটা। রসুন ৩ কোয়া। শুকনামরিচ ৪,৫টি।
আস্তসরিষা আধা চা-চামচ। লবণ স্বাদ মতো। সরিষার তেল পরিমাণ মতো।
পদ্ধতি: তাওয়ার উপরে খোসাসহ কচু পুড়িয়ে নিন এবং ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে পুরোটা ভালোভাবে কম আঁচে পুড়িয়ে নিতে হবে যাতে ঠিক মতো সিদ্ধ হয়। তারপর
খোসা ফেলে দিয়ে পাতলা টুকরা করে কেটে নিতে হবে।
প্যানে
তেল গরম করে প্রথমে চিংড়িগুলো ভেজে তুলুন। শুকনামরিচও মচমচে করে ভেজে তুলে রাখতে
হবে। এইবার সরিষার ফোঁড়ন দিয়ে পেঁয়াজ আর রসুন হালকা করে ভেজে আগেই পুড়িয়ে, কেটে রাখা কচু আর লবণ দিয়ে ভেজে নিতে হবে।
এবার
সব ভাজা উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে শিলপাটা বা মিক্সিতে বেটে নিলেই ভর্তা তৈরি।
চিংড়ি কচুর চচ্চড়ি
উপকরণ:
• চিংড়ি – ২৫০ গ্রাম
• কচু – ৫০০ গ্রাম (লম্বা করে কাটা) • পিঁয়াজ বাটা – ২ টেবিল চামচ
• রসুন বাটা – ১/৩ চা চামচ
• আদা বাটা – ১/৩ চা চামচ
• জিরা বাটা – ১/৩ চা চামচ
• হলুদের গুড়া – ১/৩ চা চামচ
• মরিচের গুড়া – ১/২ চা চামচ
• কাঁচামরিচ – ৬টা (ফালি করে কাটা)
• লবণ ও তেল পরিমাণ মত
পদ্ধতি:
• গরম তেলে প্রথমে চিংড়ি ও পরে কচু ভেজে নিন।
• ভাজা কচু ও চিংড়িতে একে একে সব মসলা, লবণ ও
কাঁচামরিচ দিয়ে কিছুক্ষণ কষান।
• কষানো হয়ে গেলে তাতে পানি দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢেকে দিন।
• পানি শুকিয়ে গেলে নামিয়ে নিন ।
উপকরনঃ
শুঁটকী মাছ - ৬০- ৭০ গ্রাম ( আপনি
যেকোনো শুঁটকি দিতে পারেন। এখানে লইটটা শুঁটকি দেয়া হয়েছে)
কচু - ২৫০ গ্রাম
পেঁয়াজ বাটা- ৫ চা চামচ
রসুন বাটা- ২ চা চামচ
আদা বাটা- ২ চা চামচ
হলুদের গুঁড়া- ১ চা চামচ
জিরার গুঁড়া- ১ চা চামচ
কাঁচা মরিচ- ১০-১২ টি অথবা আপনার স্বাদ
অনুযায়ী ( মাঝখান থেকে চিরে দিন)
তেল- আনুমানিক ১/২ কাপ
লবন- ১ চা চামচ অথবা আপনার স্বাদ অনুযায়ী
পদ্ধতিঃ
শুঁটকি মাছ ১ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে গরম
পানিতে ১০ মিনিট এর মত ভিজিয়ে রাখুন। এরপর ভাল করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে রাখুন। কচুর
খোসা ভাল করে ফেলে ধুয়ে নিন। ছোট টুকরা করে কেটে নিন।
পাত্রে তেল গরম করে এর মধ্যে পেঁয়াজ
বাটা, আদা বাটা, রসুন
বাটা, জিরার গুঁড়া, হলুদের
গুঁড়া এবং কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাল করে কষিয়ে নিন। যখন মশলা থেকে তেল আলাদা হয়ে
যাবে তখন কচু দিয়ে ভাল করে নাড়ুন। এরপর শুঁটকি দিয়ে সাবধানে নাড়ুন যাতে শুঁটকি
ভেঙে না যায়। ১০ মিনিট মাঝারি আঁচে রান্না করুন। মাঝে মাঝে নেড়ে দিন। এরপর ২ কাপ
উষ্ণ গরম পানি দিয়ে ফুটিয়ে তুলুন।
পাত্রটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ১৫-২০ মিনিট
অথবা কচু সিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। সাদা ভাতের সাথে পরিবেশন করুন।
পাঁচ মিশালি মাছ দিয়ে
কচুর ঘণ্ট
উপকরণ: কচুর ডগা ২ কাপ (সবুজ অংশ)। রুই, আইড়, কাতল, পাঙাশ ও ইলিশ মাছ— প্রতিটা ১ টুকরা করে (যে কোনো
বড় মাছের লেজের অংশ,
যা সাধারণত কেউ খেতে চায় না)। হলুদ প্রয়োজন মতো। পেঁয়াজ ১টি কুচি
করা। রসুন ৩ কোয়া, কুচি করা। লবণ স্বাদমতো। ধনেপাতা-বাটা
৩ থেকে ৪ চা-চামচ (পাতার চেয়ে ডাটার অংশ বেশি থাকবে এবং পাতলা করে বেটে নিতে হবে)।
কাঁচামরিচ ৪ থেকে ৫টি (ধনেপাতার সঙ্গে পাতলা করে বাটা)। গন্ধরাজ লেবুর রস ১
চা-চামচ। তেল প্রয়োজন মতো।
পদ্ধতি: মাছের টুকরাগুলো লবণ আর
হলুদ দিয়ে মাখিয়ে হালকা করে ভেজে, কাঁটা বেছে নিন। কচুর ডগা লবণ আর হলুদ দিয়ে
সিদ্ধ করে, ডাল ঘুটনি দিয়ে ঘুটে নেবেন। প্যানে তেল গরম
করে পেঁয়াজ আর রসুন সোনালি করে ভেজে সিদ্ধ কচু দিয়ে, ভালোভাবে
মিশিয়ে পানি শুকিয়ে ফেলুন।
কচুর পানি শুকিয়ে গেলে কাটা ছাড়ানো মাছ ঝুরি, ধনেপাতা-কাঁচামরিচ-বাটা,
লেবুর রস মিশিয়ে লবণ চেখে নামিয়ে নিন। গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন
করুন।
টিপস: কচু কাটা বা ধোয়ার সময় লক্ষ করবেন হাত চুলকায় কিনা। যদি চুলকায় তবে
কচু সিদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নেবেন। যদি রান্নার পর চুলায় থাকা অবস্থায় স্বাদ নিতে
গিয়ে গলা ধরে তবে লেবুর রসের পরিমাণ খানিকটা বাড়িয়ে দিতে পারেন। তবে যেকোনো কচুর
তরকারি না চেখে পরিবেশন করা ঠিক না। অনেক সময় কচু বেশ পানসে প্রকৃতিরও হয়ে থাকে।
সেক্ষেত্রে নামানোর আগে অল্প একটু চিনি মিশিয়ে স্বাদ ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে।ঠলে
মোটাকুচি করে কাটা পুদিনাপাতা দিয়েই নামিয়ে ফেলতে হবে।
ভুনা নারকেলি কচু
উপকরন-
নারকেলি কচু – ৩০০ গ্রাম
সয়াবিন তেল – আধা কাপ
পেঁয়াজ কুঁচি – বড় ২ টি
আদা ও রসুন বাটা – ১ চা চামচ
হলুদ গুঁড়া – পরিমান মতো
শুকনা মরিচের গুঁড়া – আধা চা চামচ
জিরা বাটা – আধা চা চামচ
ধনে গুঁড়া – আধা চা চামচ
তেঁতুলের পানি – ২ চা চামচ
চিনি – স্বাদ মতো
লবন – স্বাদ মতো
পাঁচ ফোঁড়ন – আধা চা চামচ
প্রণালী –
১) নারকেলি কচুর মাঝের অংশের খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে গোল গোল করে কেটে ১৫-২০
মিনিট লবন মাখিয়ে রাখতে হবে।
২) এবার ভাল মতো ধুয়ে নিয়ে কচুর সাথে সামান্য হলুদ মিশিয়ে ভাল মতো মেখে
নিন
৩) ফ্রাই প্যানে তেল গরম করে কচু গুলোর দুই পাশ হাল্কা করে করে ভেজে নিন।
বাদামী রঙ ধরার আগেই উঠিয়ে নিয়ে টিস্যুর উপরে রাখুন, এতে বাড়তি তেল
ঝরে যাবে ।
৪) এবার কচু ভাজা তেলের ভেতর পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে হালকা বাদামী করে ভেজে
নিন। পেঁয়াজ বাদামী রঙ হলে এর ভেতর হলুদ গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া,
ধনে গুঁড়া, জিরা গুঁড়া ও লবন মেশান।
মসলা ভালো করে কষান। মশলা কষানো হয়ে গেলে এর ভেতর ভেজে রাখা কচুর টুকরা গুলো
দিয়ে দিন। পরিমান মতো পানি দিয়ে ঢেকে হালকা আঁচে সিদ্ধ হতে দিন।
৫) পাঁচফোড়ন টেলে নিয়ে আগে থেকেই গুঁড়ো করে রাখুন। এবার তেঁতুলের মাড়
বের করে এর সাথে পাঁচফোড়ন গুঁড়ো ও চিনি মেশান। এই মিশ্রণটি কচুতে দিয়ে দমে
রাখুন। কচু তেলের উপর উঠলে নামিয়ে ধনেপাতা দিয়ে সাজিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
No comments:
Post a Comment